যে স্বভাব গুলোর কারণে মানুষের পতন হয়

যে  স্বভাব গুলোর কারণে মানুষের পতন হয় 

একজন মানুষের পতন বলতে সাধারণত তার বর্তমান পরিস্থিতির থেকেও আরও কঠিনতম পরিস্থিতিতে নিমজ্জিত হওয়া।এক জন মুমিন ব্যক্তি কখনো আরাম প্রিয়, পরিশ্রমবিমুখ, কোমলতা প্রিয়, অলস, সুখপ্রত্যাশী, অমনোযোগী ও দুনিয়া পূজারি হতে পারে না।মানুষের পতন হয় যে কারণে

যে ব্যক্তি দুনিয়ার মহব্বতে ,সম্মান ও মর্যাদার আশায় থাকে ওই ব্যক্তির পরিণতি দুনিয়া ও আখিরাতে অনেক ভয়াবহ হবে। যে ব্যক্তি আরাম প্রিয়তার দিকে ঝুঁকে পড়েছে, দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হয়েছে, ইসলামের জন্য মৃত্যুকে  ভয় করেছে, তাদের অনিবার্য ধ্বংসের ব্যাপারে সতর্ক বার্তা হজরত মুহাম্মদ (সা) তুলে ধরেছেন।  

হাদিস শরীফে বলা হয়েছে ,হজরত মুহাম্মদ (সা) তার প্রিয় সাহাবি হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহুকে ইয়েমেনের গভর্নর করে পাঠানোর সময় বলেছিলেন ,’হে মুয়াজ! আরাম প্রিয়তা থেকে বিরত থাকবে। কেননা, আল্লাহর বান্দারা আরাম প্রিয় হন না।’ (মিশকাত)

কোরআন ও হাদিসে মানুষের সব ধরনের মন্দ স্বভাব পরিহার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি স্বভাব হলো :

১।  বেশি খাওয়া ও ভালো খাবারের প্রতি লোভী হওয়া  (মানুষের পতন হয় যে কারণে)

বেশি বেশি খাওয়া গুনাহের মূল কারণ। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা) সব সময় খাবার  বলেছেন। হাদিস শরীফেও ক্ষুধার্থ থাকার অনেক ফজিলতের কথা বলা হয়েছে। 

হাদিস শরীফে বলা হয়েছে ,হজরত মুহাম্মদ (সা) বলেছেন ,মানুষের জন্য পূরণ করার ক্ষেত্রে পেটের তুলনায় খারাপ কোনো পাত্র নেই। (বুখারী ,হাদিস নং : ৪৩৪৩)

খাবার  খেলে অন্তর স্বচ্ছতা হয় ,কুপ্রবৃত্তি দুর্বল হয়ে যায়। বেশি খাবার খেলে শরীর অলস হয়ে যায় ফলে অতিরিক্ত ঘুম হয় যার কারণে ইবাদাতে কষ্ট  হয়। অনেক সময় অতিরিক্ত ঘুমের কারণে নামাজ সময় মতো আদায় করা যায় না এবং নামাজে ভুল হয়ে যায়। দুনিয়ার চিন্তাভাবনা কমে আসে। 

২।  আল্লাহ ও তাঁর স্মরণ থেকে উদাসীন থাকা 

মানুষের একটি নিকৃষ্টতম স্বভাব হলো তার স্রষ্টার স্মরণ থেকে বিমুখ থাকা। কেননা তা মানবহৃদয়কে মৃতে পরিণত করে এবং অন্যান্য মন্দ স্বভাবকে উৎসাহিত করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে আল্লাহর স্মরণ করে এবং যে আল্লাহকে স্মরণ করে না তাদের দৃষ্টান্ত হলো জীবিত ও মৃতের মতো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৪০৭)

৩।  অধিক কথা বলা 

জবান হলো অন্তরের দূত। অন্তরের যাবতীয় নকশা ও কল্পনা কথার মাধ্যমে প্রকাশ পায়।  তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন ,তোমাদের প্রত্যেকটি কোথায় সংরক্ষণ করা হয়। (সূরা : কাফ , আয়াত নং : ১৮)

হাদিস শরীফে হজরত মুহাম্মদ (সা) বলেছেন ,যে ব্যক্তি আমাকে লজ্জাস্থান ও জিহ্বার ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে পারবে আমি তার জন্য জান্নাতের নিশ্চয়তা দেব। (বুখারি ,হাদিস নং : ৬৪৭৪)

অতিরিক্ত কথা বললে মিথ্যা কথা বেশি বলা হয়ে যায়। যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলে তাকে মুনাফিক বলা হয়। মৃত্যুর পরে মুনাফিকের স্থান হবে জাহান্নামে সর্ব নিম্ন স্তরে। 

মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন ,‘সুতরাং তোমরা বর্জন করো মূর্তিপূজার অপবিত্রতা  বং দূরে থাকো মিথ্যা কথন থেকে।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৩০)

অতিরিক্ত কথা বলা ব্যক্তি পরনিন্দা ও গীবত করে থাকে। যা কবিরা গুনাহ যার কোনো ক্ষমা হয় না। তাছাড়াও গীবতকারীকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে। 

 

৪। রাগ ও ক্রোধ 

রাগ অত্যন্ত খারাপ একটি কাজ। অনিয়ন্ত্রিত রাগ মানুষের হিতাহিত জ্ঞান কেড়ে নেয় এবং অন্যায় কাজে উদ্বুদ্ধ করে। রাগ দোজখের আগুনের একটি টুকরো। এজন্য রাগান্বিত ব্যক্তির চেহারা লাল হয়ে যায়। 

হাদিস শরীফে বলা হয়েছে , রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘দুশ্চরিত্র ও রূঢ় স্বভাবের মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮০১)

অন্য হাদিসে বলা হয়েছে ,রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ওই ব্যক্তি বীরপুরুষ নয়, যে অন্যকে ধরাশায়ী করে। বরং সেই প্রকৃত বীর, যে রাগের সময় নিজেকে সংযত রাখতে পারে।’ (সহিহ : বুখারি, হাদিস : ৬১১৪)

৫।  হিংসা করা 

কোনো ব্যক্তিকে আরাম আয়েশ বা প্রাচুর্যপূর্ণ অবস্থায় দেখে তার সে নিয়ামত দূরীভূত হয়ে নিজের জন্য হাসিল হওয়ার আকাঙ্খাকে হিংসা বলে। হিংসা মানুষের সামাজিক ও জঘন্য একটি ব্যাধি। যার ফলে মানুষের সব আমল নষ্ট হয়ে যায়। 

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা হিংসা থেকে বেঁচে থাকো। কেননা হিংসা নেকিকে এমনভাবে খেয়ে ফেলে, যেভাবে আগুন কাঠকে খেয়ে ফেলে অর্থাৎ জ্বালিয়ে দেয়।’( সুনানে আবু দাউদ ,হাদিস নং : ৪৯০৩)

প্রতিহিংসা কত বড় গোনাহ তা বোঝাতে গিয়ে ইমাম গাজ্জালি (রহ.) লেখেন, ‘পৃথিবীতে সর্বপ্রথম পাপ হলো হিংসা। হজরত আদম (আ.)-এর মর্যাদা দেখে তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয় ইবলিস। ঈর্ষা ও হিংসা থেকেই ইবলিসের মনে জন্ম নেয় অহংকার। আর অহংকারের কারণে সে হজরত আদম (আ.)-কে সিজদা করতে অস্বীকার করে। ফলে সে চিরদিনের জন্য অভিশপ্ত ও মরদুদ হয়ে যায়।’

মহান আল্লাহ বলেন, (হে নবী আপনি বলুন!) আমি হিংসুকের হিংসা থেকে আশ্রয় চাই, যখন সে হিংসা করে।’( সুরা ফালাক,আয়াত নং  : ৫)

৬। কৃপণতা 

কৃপণ ব্যক্তিকে মহান আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেন না। সম্পদের মোহই কৃপণতার মূল কারণ। সম্পদের প্রতি ভালোবাসার কারণে মানুষ আল্লাহকে ভুলে দুনিয়ার প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়ে পরে। আমানতের খিয়ানত ,বিশ্বাসঘাতকতা ও নির্দয়তার মতো মন্দ স্বভাবের সৃষ্টি হয় কৃপণতা থেকে। 

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন,‘আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে যা তাদের দিয়েছেন, তাতে যারা কৃপণতা করে তাদের জন্য তা মঙ্গল—এটা যেন তারা কিছুতেই মনে না করে। বরং এটা তাদের জন্য অমঙ্গল। যে বিষয়ে তারা কৃপণতা করবে, কিয়ামতের দিন তাদের গলায় তার বেড়ি পরিয়ে দেওয়া হবে।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৮০)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কৃপণ ব্যক্তি আল্লাহ থেকে দূরে, জান্নাত থেকে দূরে এবং মানুষের থেকে দূরে থাকে। কিন্তু জাহান্নামের নিকটবর্তী থাকবে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১৯৬১)

৭। লোভ করা  

লোভ মানুষকে অধঃপতনের দিকে  নিয়ে যায়।  লোভের কারণেই মানুষ এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করে। বোনদের প্রাপ্য অংশ মেরে খায়। প্রতিপক্ষকে খুন করে ক্ষমতা দখল করে।

হাদিস শরীফে বলা হয়েছে ,হজরত মুহাম্মদ (সা) বলেছেন ,তোমরা লোভকে নিয়ন্ত্রণ করো। কারণ এটা  তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদেরকে ধ্বংস করেছে। (মুসলিম ,হাদিস নং : ২৫৭৮)

৮।  অহংকার 

অহংকার হলো অন্যের চেয়ে নিজেকে বড় মনে করা। মানুষ যখন অহংকারী হয়, তখন তার মধ্যে অসংখ্য গোনাহ ও দোষের সমাবেশ ঘটে।অহংকার ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা ও তার নবী রাসূল কেউই পছন্দ করে না। 

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে , ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ অহংকারী দাম্ভিক লোককে পছন্দ করেন না।(’ সুরা লোকমান,আয়াত নং  : ১৮)

হজরত মুহাম্মদ (সা) বলেছেন ,‘যার অন্তরে এক অণু পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৯১)

৯। সম্মান ও সম্পদের মোহ 

সম্মান ও সম্পদের মোহ বহু পাপের কারণ, যা মানুষকে দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ছাগলের পালে দুটি ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘ ছেড়ে দিলে যেমন ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, সম্মানের লিপ্সা ও সম্পদের মোহ মানুষের দ্বিনের জন্য তার চেয়ে বেশি ক্ষতিকর।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৩৭৬)

আল্লাহ তায়ালা বলেছেন ,এই পরকাল আমি তাদের জন্য নির্ধারিত করি ,যারা দুনিয়ার বুকে ঐদ্ধত্য প্রকাশ করতে ও অনর্থ সৃষ্টি করতে চায় না। (সূরা : কসাস ,আয়াত নং  : ৮৩)

১০।  দুনিয়ার মোহ 

দুনিয়াপ্রীতি শুদু সম্পদ ও পদের মোহকেই বলে না ,বরং ইহজীবনের যেকোনো অবৈধ কামনাকে পূর্ন করার প্রচেষ্টা ও খায়েশকেই দুনিয়াপ্রীতি বা দুনিয়ার মোহ বলে। 

। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়া ভালোবাসল, সে তার পরকালকে ক্ষতিগ্রস্ত করল। আর যে ব্যক্তি আখিরাতকে ভালোবাসল, সে তার দুনিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করল। সুতরাং তোমরা অস্থায়ী বস্তুর ওপর স্থায়ী বস্তুকে প্রাধান্য দেবে।’ (মুসনাদে আহমদ : ৪/৪১২)

১১।  আত্মতুষ্টি বা আত্মগৌরব 

আত্মগৌরব করা অহংকারের প্রাথমিক রূপ। আত্মপ্রশংসা ও আত্মগৌরব মানুষকে বাস্তবতাবিমুখ করে। ইসলাম আত্মগৌরব থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আত্মপ্রশংসা কোরো না, কে আল্লাহভীরু এ সম্পর্কে তিনিই সম্যক অবগত।’ (সুরা : নাজম, আয়াত : ৩২)

১২।  অতিরিক্ত ব্যয় করা 

ব্যয়ের ক্ষেত্রে কৃপণতা যেমন দূষণীয়, অনুরূপ অপব্যয় এবং অপচয় দূষণীয়। ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ কাজেও অপচয় ও অপব্যয় নিষিদ্ধ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা খাও এবং পান করো; কিন্তু অপব্যয় করবে না। নিশ্চয়ই তিনি (আল্লাহ) অপব্যয়কারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৩১)

জাহান্নাম কয়টি ও কি কি ? জাহান্নামের কোন স্তরে কারা থাকবে ?

 

Sharing Is Caring:

Leave a Comment