তওবা শব্দের অর্থ ফায়ার আসা ও প্রত্যাবর্তন করা। পারিভাষিক অর্থে তাওবা হলো, শরিয়ত বহির্ভূত নিষিদ্ধ কাজ ত্যাগ করে ইসলাম নির্দেশিত কাজ করার মাধ্যমে আল্লাহর পথে ফিরে আসা এবং আল্লাহর বিধানের ওপর অটল-অবিচল থাকা।
আমরা দৈনন্দিন কাজ-কর্মে ,চলতে – ফিরতে জানায় অজানায় অনেক গুনাহের কাজ করে থাকি ।যার ফলে আমাদের মৃত্যুর পরে জাহান্নামের সাজা ভোগ করতে হয় ।হাদিসে বলা হয়েছে ‘দুনিয়া আখিরাতের শস্যক্ষেত ‘।
অর্থাৎ দুনিয়াতে আমরা যে যে রকম কাজ করে যাব মৃত্যু পরে আমাদের সেই রকম সাজা ভোগ করতে হবে ।শস্য ক্ষেতে যেমন বীজ রোপণ করে ভাল পরিচর্যা করলে ভাল ফসল পাওয়া যায়।
তেমনি দুনিয়াতে ভাল কাজ করে গেলে আখিরাতে এর ফল পাওয়া যাবে ।কেউ কেউ বিনা হিসেবে জান্নাত লাভ করবে ।আবার কেউ সাজা ভোগ করার পর জান্নাতে যাবে ।আবার কেউ একেবারে জাহান্নামে রয়ে যাবে ।
মহান আল্লাহ তায়ালা পরম ক্ষমাশীল। কোনো গুনাহের কাজ করলে মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে তওবা করলে আল্লাহ তায়ালা তার বান্দার সব গুনাহ ক্ষমা করে দেন। মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে তওবা করে ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহ তায়ালা খুশি হন।
গুনাহের বোঝা অনেক বড় হলেও মহান আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে নিরাশ হতে নিষেদ করেছেন।গুনাহ করার পরে বান্দা যদি তার অপরাধ বুঝতে পেরে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান ,তখন আল্লাহ তায়ালা শুধু বান্দার গুনাহ ক্ষমাই করেন না বরং গুনাহকে নেকি দ্বারা পরিবর্তন করে দেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘কিন্তু যারা তওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের গুনাহগুলোকে নেকি দিয়ে পরিবর্তন করে দেবেন।’ (সুরাঃ ফুরকান,আয়াত নং ঃ ৭০)
মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন মজীদে ইরশাদ করেছেন , ‘হে আমার বান্দারা! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ; আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরাঃ জুমার, আয়াত নং ঃ৫৩)
তওবা করার পূর্ব শর্ত
তওবার পূর্বশর্ত চারটি।
১) কৃত গুনাহের ওপর অনুতপ্ত হওয়া
২) গুনাহ সম্পূর্ণ পরিহার করা
৩) ভবিষ্যতে না করার দৃঢ় সংকল্প করা
৪) বান্দার হক নষ্ট করে থাকলে তা আদায় করা। (তিরমিজি: ৪০২, আল মিনহাজ ফি শরহি মুসলিম: ১৭/৫৭, ফতোয়ায়ে ফকিহুল মিল্লাত: ২/২৩৯-২৪০)
মহান আল্লাহ তায়ালা তওবা কারিকে অনেক ভালবাসেন ।মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন ,”নিশ্চয় আল্লাহ তওবাকারীদের ভালবাসেন এবং তাদেরকেও ভালোবাসেন যারা পবিত্র থাকে “ ( সূরা : বাকারা ,আয়াত নং : ২২২)
প্রিয়নবী (স.) ইরশাদ করেছেন ‘যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার (আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা) করবে, আল্লাহ তাকে প্রত্যেক বিপদ হতে মুক্তির ব্যবস্থা করবেন, সকল দুশ্চিন্তা হতে মুক্ত করবেন এবং তাকে এমন উৎস থেকে রিজিক দেবেন যা সে কল্পনাও করতে পারবে না।’ (সুনানে আবু দাউদ: ১৫১৮)
তওবা করার নিয়ম
তওবা করার জন্য প্রথমে সহীহ শুদ্ধ ভাবে অজু করতে হবে। তারপর দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে ।গত জিবনের সব পাপ এবং আদেশ অমান্য করার অপরাধ থেকে ক্ষমা চাইতে হবে ।
তওবা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যখন ইচ্ছা হয় তখনি চাওয়া যায় ।মহানবি হজরত মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন ,নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তার বান্দার তাওবা কবুল করেন ,যতক্ষণ না সে (মৃত্যু যন্ত্রণায়) গরগর করে ।(তিরমিজি ,হাদিস নং ঃ ৩৫৩৭)
অনেকেই মনে করেন মৃত্যু সময় কাছাকাছি এলে তওবা করে নেব। কিন্তু আমরা কেউ জানিনা আমাদের মৃত্যু কখন হবে। তাই পাপে মগ্ন না থেকে আমাদের উচিত তাড়াতাড়ি তওবা করা।
আমাদের সমাজে দেখা যায় তাওবা পড়ানোর রীতি প্রচলিত। কোনো একজন মানুষ খুবই মুমূর্ষ অবস্থায় আছে, বেঁচে থাকার আশা নেই—তখন মসজিদের ইমাম বা কোনো হুজুর ডেকে এনে তাওবা পড়ানো হয়। অথচ তাওবা কাউকে ডেকে এনে করানো বা পড়ানোর বিষয় নয় বরং তাওবা হলো ব্যক্তি মানুষের একান্ত হৃদয়-মনের ব্যাপার; ব্যক্তি নিজেই স্বয়ং আল্লাহর কাছে তাওবা করবে।
তওবা নামাজের নিয়ম
গুনাহ হয়ে গেলে তওবার নিয়তে নামাজ পড়াকে তওবার জমজ বলে। তওবার নামাজ পড়া মুস্তাহাব।তওবার নামাজ নফল নামাজের মতো। প্রথমে অজু করে তারপর নামাজ পড়তে হবে।
অজু ও নামাজের মাঝখানের সময়ে দুনিয়াবী কোনো কাজ বা কথা না বলাই উত্তম। এ নামাজ পড়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনো সূরা নেই। যেকোনো সূরা দিয়েই তওবার নামাজ পড়া যায়।
হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার মতো এভাবে অজু করবে, অতঃপর দুই রাকাত নামাজ আদায় করবে এবং এর মাঝখানে দুনিয়ার কোনো খেয়াল থাকবে না ,তার আগের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। (সহীহ বুখারী : ১৫৯)
হজরত আসমা ইবনুল হাকাম (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি হজরত আলী (রা.)-কে বলতে শুনেছি,…তিনি বলেন, হজরত আবু বকর (রা.) আমাকে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন এবং তিনি সত্যই বলেছেন।
তিনি বলেন, আমি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘যখন কোনো বান্দা কোনো ধরনের গোনাহ করে উত্তমরূপে অজু করে দাঁড়িয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে এবং আল্লাহর কাছে গোনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন।’ (আবু দাউদ : ১৫২১)
তওবা করার সময় সীমা
তিন মুহূর্ত আসার আগ পর্যন্ত মহান আল্লাহ তার বান্দার তাওবা কবুল করেন। কিন্তু এরপর আর তাওবা কবুল করা হয় না। নিম্নে সেই তিন মুহূর্ত বর্ণনা করা হলো :
১। মৃত্যু আসার আগ পর্যন্ত। (সুরা : নিসা, আয়াত : ১৮)
২। আজাব চলে আসার আগ পর্যন্ত । (সুরা : মুমিনুন, আয়াত : ৮৫)
৩। পশ্চিমাকাশে সূর্যোদয় হওয়ার আগ পর্যন্ত। (মুসলিম, হাদিস : ৬৭৫৪)
তওবা নামাজের নিয়ত
উচ্চারণ
নাওয়াইতু আন্ উছাল্লিয়া লিল্লাহি তায়ালা রাক্ আতাই ছালাতিত্ তাওবাতি মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ্ শারীফাতি।— আল্লাহুআকবার।তওবা নামাজের নিয়ত আরবিতে না জানলে বাংলায় নিয়ত করা যাবে।
বাংলায় নিয়ত
হে আল্লাহ আমি কেবলা মুখি হয়ে আল্লাহর ওয়াস্তে দুই রাকাত সালাতুত তওবার নামাজের নিয়ত করছি।আল্লাহু আকবার।
নিয়ত করার পরে নফল নামাজের মতো করে দুই রাকাত নামাজ পড়তে হবে। নামাজ শেষে কয়েক বার দরূদ শরীফ পাঠ করে তওবার দোয়া পাঠ করতে হবে এবং সাইয়েদুল ইস্তিগফার পাঠ করতে হবে।
তওবার দোয়া
উচ্চারণঃ “আসতাগফিরুল্লা-হাল আ’যীমাল্লাযী লা- ইলা- হা ইল্লা হুওয়াল হা’ইয়ুল ক্বাইয়ূমু ওয়া আতুবু ইলাইহি”
অর্থ
আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। যিনি ছাড়া ইবাদতের আর কোন যোগ্য উপাস্য নেই। যিনি চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী। আমি তাঁর কাছে তওবা করছি।
সাইয়েদুল ইস্তিগফার বা তওবার শ্রেষ্ঠ দোয়া
সাইয়েদুল ইস্তেগফার বাংলা উচ্চারণ
‘আল্লাহুম্মা আনতা রাব্বি, লা-ইলাহা ইল্লা আনতা খলাকতানি, ওয়া আনা আবদুকা, ওয়া আনা আলা আহদিকা, ওয়া ওয়া‘দিক মাসতাতা‘তু, আউজুবিকা মিন শাররি মা সানা‘তু, আবু-উ লাকা বিনি‘মাতিকা আলাইয়া ওয়া আবু-উ বিজাম্বি ফাগফিরলি ফা-ইন্নাহু লা ইয়াগফিরুজ জুনুবা ইল্লা আনতা।’
অর্থ
হে আল্লাহ, আপনি আমার রব, আপনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। আমাকে আপনি সৃষ্টি করেছেন, আমি আপনার বান্দা। আমি যথাসাধ্য আপনার সঙ্গে কৃত প্রতিশ্রুতির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকব।
আমি আমার নিকৃষ্ট আমল থেকে আপনার কাছে আশ্রয় চাই, আপনার যে অসংখ্য নেয়ামত ভোগ করছি এ জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি। আমি আমার কৃত অপরাধ স্বীকার করছি। অতএব আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। আপনি ছাড়া অপরাধ ক্ষমা করার কেউ নেই। -সুনানে আবু দাউদ : ৫০৭০
যায় দোয়া মুখস্থ না হলে নিজ ভাষায় মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে তওবা করা যায়। তাতেও মহান আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন।