সূরা আলাকের বাংলা অর্থ সহ উচ্চারণ ও এর শানে নুযুল 

পবিত্র কুরআনে ১১৪ টি সূরা রিয়েছে। তার মধ্যে সূরা এলাকা ৯৬ তম সূরা। সূরা আলাকের আয়াত সংখ্যা ১৯ টি এবং রুকু ১ টি। এ সূরাটি পবিত্র মক্কা নগরীতে অবতীর্ন হয়েছিল। 

পবিত্র কুরআনের সূরা গুলোকে ২ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তা হলো মাক্কী ও মাদানী। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা) মক্কায় অবস্থান রত সময়ে যে সূরা গুলো নাজিল হয়েছে সেগুলো মাক্কী  সূরার অন্তর্ভুক্ত। 

আর মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা) মদিনায় হিজরতের পরে যে সূরা গুলো নাজিল হয়েছে সেগুলোকে মাদানী সূরা বলা হয়। সূরা এলাকা মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা) মক্কায় অবস্থানরত সময়ে নাজিল হয়েছে তাই এ সূরা মাক্কী সূরার অন্তর্ভুক্ত। 

সূরা আলাকের ১৯ তম আয়াতে ১ টি সিজদাহ রয়েছে। আলাক  শব্দের অর্থ হলো ‘জমাট বাধা রক্ত’ 

এ সূরা দ্বিতীয় আয়াতে আলাক  শব্দ থেকে সূরা নামকরণ করা হয়েছে। এই ছোট্ট সূরাটিতে তিনটি বিষয়বস্তুর অবতারণা করা হয়েছে ।১। তাওহীদ। ২। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী সাল্লামকে উপদেশ দান এবং ৩।  আখিরাত ।

পবিত্র কুরআনের প্রথম সূরা আল ফাতিহা  হলেও, সর্বপ্রথম যে আয়াত নাযিল হয়েছে তা হল সূরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত। মুলত এই পাঁচ আয়াত দিয়েই ওহির সূচনা হয়েছিল হেরা গুহায় হজরত মুহাম্মদ (সা) এর উপর। 

এ সূরাটি দুইটি অংশে বিভক্ত।  এই অংশটিই সর্বপ্রথম অহী যা শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা)  -এর উপর ঐ সময় অবতীর্ণ হয়। দ্বিতীয় অংশটি ষষ্ঠ আয়াত থেকে শুরু হয়ে উনিশ আয়াত অবধি বিস্তৃত।হজরত মুহাম্মদ (সা) কাবাগৃহের পাশে নামাজ আদায় করছিল।  জেহেল তাকে ধমক দিয়ে নামাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেন। ওই সময় এ সূরা দ্বিতীয় অংশটি নাজিল হয়। 

ওহীর সূচনা 

মুহাদ্দিসগণ অহীর সূচনাপর্বের ঘটনা নিজের সনদের মাধ্যমে ইমাম যুহরী থেকে বর্ণনা করেছেন। ইমাম যুহরী এ ঘটনা হযরত উরওয়া ইবনে যুবাইর থেকে এবং তিনি নিজের খালা হযরত আয়েশা (রা:) থেকে বর্ণনা করেছেন। হযরত আয়েশা (রা:) বলেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর অহীর সূচনা হয় সত্য স্বপ্নের (কোন কোন বর্ণনা অনুসারে ভালো স্বপ্নের) মাধ্যমে।

 তিনি যে স্বপ্নই দেখতেন, মনে হতো যেন দিনের আলোয় তিনি তা দেখছেন। এরপর তিনি নির্জনতা প্রিয় হয়ে পড়েন। এরপর কয়েকদিন হেরা গুহায় অবস্থান করে দিনরাত ইবাদাতের মধ্যে কাটিয়ে দিতে থাকেন। ঘর থেকে খাবার-দাবার নিয়ে তিনি কয়েকদিন সেখানে কাটাতেন। খাবার শেষ হলে বাড়ি  এবং পুনরায় খাবার নিয়ে যেতেন। মাঝে মাঝে তার সহধর্মিনী হযরত খাদীজার (রা:) খাবার নিয়ে যেতেন। । 

একদিন তিনি হেরা গুহার মধ্যে ছিলেন। হঠাৎ তার ওপর ওহী নাযিল হলো। ফেরেশতা এসে তাকে বললেন :“ পড়ুন ” এর পর হযরত আয়েশা (রা)নিজেই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উক্তি উদ্ধৃত করেছেন :আমি বললাম, “আমি তো পড়তে জানি না। ”একথায় ফেরেশতা আমাকে ধরে বুকের সাথে ভয়ানক জোরে চেপে ধরলেন। 

এমনকি আমি তা সহ্য করার শক্তি প্রায় হারিয়ে ফেল্লাম । তখন তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন , “পড়ো ” আমি বলালাম “আমি তো ,পড়তে জানি না। ”তিনি দ্বিতীয় বার আমাকে বুকের সাথে ধরে ভয়ানক চাপ দিলেন। আমার সহ্য করার শক্তি প্রায় শেষ হতে লাগলো।

তখন তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, “পড়ো ”আমি আবার বলালাম ,“আমি তো পড়া জানি না । ”তিনি তৃতীয় বার আমাকে বুকের সাথে ভয়ানক জোরে চেপে ধরলেন আমার সহ্য করার শক্তি খতম হবার উপক্রম হলো।তখন তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন ,(আররবী- اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ ) (পড়ো নিজের রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন ) এখানে থেকে (আরবী -عَلَّمَ الْإِنسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ) (যা সে জানতো না ) পর্যন্ত ।

 হযরত আয়েশা (রা ) বলেন ,এরপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাঁপতে কাঁপতে সেখান থেকে ফিরলেন । তিনি হযরত খাদীজার (রা ) কাছে ফিরে এসে বললেন, আমার গায়ে কিছু (চাঁদর – কম্বল ) জড়িয়ে দাও ! আমার গায়ে কিছু ( চাঁদর – কম্বল ) জড়িয়ে দাও ! তখন তাঁর গায়ে জড়িয়ে দেয়া হলো।

তাঁর মধ্য থেকে ভীতির ভাব দূর গেলে তিনি বললেন :“হে খাদীজা ! আমার কি হয়ে গেলো ? তারপর তিনি তাঁকে পুরো ঘটনা শুনিয়ে দিলেন এবং বললেন ,আমান নিজের জানের ভয় হচ্ছে। ”হযরত খাদীজা বললেন : “মোটেই না ।বরং খুশি হয়ে যান।আল্লাহর কসম !আল্লাহ কখনো আপনাকে অপমাণিত করবেন না। 

আপনি আত্মীয়দের সাথে ভালো ব্যবহার করেন । সত্য কথা বলেন। (একটি বর্ণনায় বাড়তি বলা হয়েছে ,আপনি আমানত পরিশোধ করে দেন , ) অসহায় লোকদের বোঝা বহন করেন । নিজে অর্থ উপার্জন করে অভাবীদেরকে দেন। মেহমানদারী করেন। ভালো কাজে সাহায্য করেন।

তারপর তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সাথে নিয়ে ওয়ারাকা ইবনে নওফলের কাছে গেলেন। ওয়ারাকা ছিলেন তাঁর চাচাত ভাই । জাহেলী যুগে তিনি ঈসায়ী ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।আরবী ও ইবরানী ভাষায় ইঞ্জিল লিখতেন। অত্যন্ত বৃদ্ধ ও অন্ধ হয়ে পড়েছিলেন। হযরত খাদীজা (রা ) তাঁকে বললেন ভাইজান !আপনার ভাতিজার ঘটনাটা একটু শুনুন। 

ওয়ারাকা রসূলুল্লাহকে (রা )বললেন :“ভাবিজা !তুমি কি দেখেছো ?” রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা কিছু দেখেছিলেন তা বর্ণনা করছেন। ওয়ারাকা বললেন: “ইনি সেই নামূস (অহী বহনকারী ফেরেশতা ) যাকে আল্লাহ মূসার (আ ) ওপর নাযিল করেছিলেন ।হায় ,যদি আমি আপনার নবুওয়াতের জামানায় শক্তিশালী যুবক হতাম ! হায়, যদি আমি তখন জীবিত থাকি যখন আপনার কওম আপনাকে বের করে দেবে ।

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন :“এরা আমাকে বের করে দেবে ? ”ওয়ারাকা বললেন :“হাঁ, কখনো এমনটি হয়নি ,আপনি যা নিয়ে এসেছেন কোন ব্যক্তি তা নিয়ে এসেছে এবং তার সাথে শত্রুতা করা হয়নি ।যদি আমি আপনার সেই আমলে বেঁচে থাকি তাহলে আপনাকে সর্বশক্তি দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করবো ।” কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই ওয়ারাকা মৃত্যুবরণ করেন।

সূরা আলাকের আরবি উচ্চারণ :

ٱقْرَأْ بِٱسْمِ رَبِّكَ ٱلَّذِى خَلَقَ

خَلَقَ ٱلْإِنسَٰنَ مِنْ عَلَقٍ

ٱقْرَأْ وَرَبُّكَ ٱلْأَكْرَمُ

ٱلَّذِى عَلَّمَ بِٱلْقَلَمِ

عَلَّمَ ٱلْإِنسَٰنَ مَا لَمْ يَعْلَمْ

كَلَّآ إِنَّ ٱلْإِنسَٰنَ لَيَطْغَىٰٓ

أَن رَّءَاهُ ٱسْتَغْنَىٰٓ

إِنَّ إِلَىٰ رَبِّكَ ٱلرُّجْعَىٰٓ

أَرَءَيْتَ ٱلَّذِى يَنْهَىٰ

عَبْدًا إِذَا صَلَّىٰٓ

أَرَءَيْتَ إِن كَانَ عَلَى ٱلْهُدَىٰٓ

أَوْ أَمَرَ بِٱلتَّقْوَىٰٓ

أَرَءَيْتَ إِن كَذَّبَ وَتَوَلَّىٰٓ

أَلَمْ يَعْلَم بِأَنَّ ٱللَّهَ يَرَىٰ

كَلَّا لَئِن لَّمْ يَنتَهِ لَنَسْفَعًۢا بِٱلنَّاصِيَةِ

نَاصِيَةٍ كَٰذِبَةٍ خَاطِئَةٍ

فَلْيَدْعُ نَادِيَهُۥ

سَنَدْعُ ٱلزَّبَانِيَةَ

كَلَّا لَا تُطِعْهُ وَٱسْجُدْ وَٱقْتَرِب 

সূরা আলাকের  বাংলা উচ্চারণ :

 

১) ইকরা বিছমি রাব্বিকাল্লাযী খালাক।

২) খালাকাল ইনছা-না মিন ‘আলাক।

৩) ইকরা’ ওয়া রাব্বুকাল আকরাম

৪) অল্লাযী ‘আল্লামা বিলকালাম।

৫) ‘আল্লামাল ইনছা-না-মা-লাম ইয়া‘লাম।

৬) কাল্লাইন্নাল ইনছা-না লাইয়াতগা।

৭) আররাআ-হুছ তাগনা-।

৮) ইন্না ইলা-রাব্বিকার রুজ‘আ-।

৯) আরাআইতাল্লাযী ইয়ানহা-

১০) ‘আবদান ইযা-সাল্লা-।

১১) আরাআইতা ইন কা-না ‘আলাল হুদা।

১২) আও আমারা বিত্তাকাওয়া-।

১৩) আরাআইতা ইন কাযযাবা ওয়া তাওয়াল্লা-।

১৪) আলাম ইয়া‘লাম বিআন্নাল্লা-হা ইয়ারা-।

১৫) কাল্লা-লাইল্লাম ইয়ানতাহি লানাছফা‘আম বিন্না-সিয়াহ।

১৬) না-সিয়াতিন কা-যিবাতিন খা-তিআহ।

১৭) ফালইয়াদ‘উ নাদিয়াহ,

১৮) ছানাদ‘উঝঝাবা-নিয়াহ।

১৯) কাল্লা- লা-তুতি‘হু ওয়াছজু দ ওয়াকতারিব 

সূরা আলাকের অর্থ :

১) পাঠ করুন আপনার পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন

২) সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে।

৩) পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু,

৪) যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন,

৫) শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।

৬) সত্যি সত্যি মানুষ সীমালংঘন করে,

৭) এ কারণে যে, সে নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করে।

৮) নিশ্চয় আপনার পালনকর্তার দিকেই প্রত্যাবর্তন হবে।

৯) আপনি কি তাকে দেখেছেন, যে নিষেধ করে

১০) এক বান্দাকে যখন সে নামায পড়ে?

১১) আপনি কি দেখেছেন যদি সে সৎপথে থাকে।

১২) অথবা খোদাভীতি শিক্ষা দেয়।

১৩) আপনি কি দেখেছেন, যদি সে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়।

১৪) সে কি জানে না যে, আল্লাহ দেখেন?

১৫) কখনই নয়, যদি সে বিরত না হয়, তবে আমি মস্তকের সামনের কেশগুচ্ছ ধরে হেঁচড়াবই-

১৬) মিথ্যাচারী, পাপীর কেশগুচ্ছ।

১৭) অতএব, সে তার সভাসদদেরকে আহবান করুক।

১৮) আমিও আহবান করব জাহান্নামের প্রহরীদেরকে

১৯) কখনই নয়, আপনি তার আনুগত্য করবেন না। আপনি সেজদা করুন ও আমার নৈকট্য অর্জন করুন।

Sharing Is Caring:

Leave a Comment