রোজা ভঙ্গের কারণ এবং রোজা মাকরূহ হওয়ার কারণ

রোজা মুসলিম ব্যক্তিদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। সারা বিশ্বের মুসলিমরা রমজান মাসে রোজা করে। মুসলিম ব্যক্তিরা রোজার মাধ্যমে মহান আল্লাহ তায়ালাকে খুশি করে এবং ঈমানের পরীক্ষা দিয়ে থাকে। 

মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন ,বান্দারা সকল কাজ করে তাদের নিজের জন্য কিন্তু রমজান মাসে রোজা করে আমার জন্য আমি নিজে প্রতিদান   দেব। (সহীহ বুখারী ,হাদিস নং : ১৯০৪)

পবিত্র রমজান মাসে আমরা সবাই রোজা করে থাকি।তাছাড়া অনেক নফল রোজা করে থাকি  কিন্তু আমাদের রোজা পালনের নিয়ম সঠিক হচ্ছে কিনা আমাদের অনেকের জানা নেই। আজকে আমরা রোজার নিয়ম সম্পর্কে জানবো। কি কি কারণে রোজা ভেঙ্গে যায়? আবার  কি কি কারণে রোজা মাকরূহ হয়? এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো। 

প্রথমে আমরা জানবো রোজা কি ?

রোজা ফারসি শব্দ। রোজার আরবি শব্দ হলো সাওম বা সিয়াম। পবিত্র কুরআন মজীদে সিয়াম নাম  উল্লেখ আছে ।

সুবহে সাদিক থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার , কামাচার ,পাপাচার এবং সকল প্রকার অপ্রয়োজনীয় কাজ থেকে বিরত থাকা কে সাওম বা রোজা বলে। 

রোজা ভঙ্গের কারণ

আল্লাহ তায়ালা রোজা ভঙ্গের প্রধান দুই টি কারণ বলেছে ।কারণ দুটি হলো ১। সহবাস করা।  ২। পানাহার করা। আর কিছু কারণ মহানবি হজরত মুহাম্মাদ (সা) তার হাদিসে উল্লেখ করেছেন ।রোজা ভঙ্গের মোট কারণ হল ৭ টি ।

১ ।সহবাস করা 

রোজা ভঙ্গের কারণ গুলর মধ্যে সবথেকে বর কারণ হল সহবাস করা ।কোন রোজাদার ব্যক্তি রমজান মাসে দিনের বেলায় ইচ্ছাকৃত ভাবে সহবাস করে সে সব থেকে বেশি গুনাহগার হবে ।পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ স্ত্রীর লজ্জাস্থানের ভেতরে অদৃশ্য হলেই রোজা ভেঙ্গে যাবে। বীর্যপাত না  হলেও রোজা ভেঙ্গে যাবে।  

 যদি সাওম ওয়াজিব অবস্থায় রমজানের দিনে সহবাস করে, তাহলে তার ওপর কাফফারা ওয়াজিব হবে, তার কঠিন অপরাধের কারণে। কাফফারা হচ্ছে গোলাম আযাদ করা, যদি তা না পাওয়া যায় তাহলে লাগাতার দু’মাস সাওম পালন করা, যদি সামর্থ্য না থাকে তাহলে ষাটজন মিসকিনকে খাদ্য দান করা। আর যদি সহবাস কারীর উপর সাওম ওয়াজিব না থাকে, যেমন মুসাফির, তাহলে তার ওপর কাযা ওয়াজিব হবে, কাফ্ফারা নয়।

২। পানাহার করা 

পানাহার বলতে বুঝায় মুখ দিয়ে কোনো কিছু প্রবেশ করা সেটি পাকস্থলীতে পৌঁছে যাওয়া ,নাক দিয়ে কোনো কিছু পাকস্থলীতে পৌঁছে গেলেও তা পানাহার করা বুঝায়। 

হজরত মুহাম্মদ (সা) বলেছেন ,তুমি ভালো করে নাকে পানি দাও ,যদি তুমি রোজাদার না হও। (সুনানে তিরমিযী ,৭৮৮)নাক দিয়ে পানি পাকস্থলীতে প্রবেশ করে রোজা না ভাঙ্গলে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা) ভালভাবে নাকে পানি নিতে নিষেধ করতেন না। 

৩।  হস্তমৈথুন 

হস্তমৈথুন হলো হাত দিয়ে বা অন্য কিছু দিয়ে বীর্যপাত করানো। হস্তমৈথুন করলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। যদি কোনো ব্যক্তি হস্তমৈথুন শুরু করেছে কিন্তু বীর্যপাত হয়নি এমন অবস্থায় সে হস্তমৈথুন থেকে বিরত হলে তার রোজা নষ্ট হবে না। 

আল্লাহর কাছে তওবা করতে হবে। বীর্যপাত না করার কারণে তার রোজা কাযা করতে হবে না। বীর্যপাত হলে রোজা নষ্ট হয়ে যাবে। ওই ব্যক্তির ওপর ফরজ হলো তওবা করা এবং ওই দিনের বাকি সময় পানাহার থেকে বিরত থাকা। পরবর্তীতে সে রোজা কাযা আদায় করা। 

৪। পানাহারের স্থলাভিষিক্ত 

পানাহারের স্থলাভিষিক্ত বলতে বুঝায় পানাহারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা। এটি ২ ভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। তা হলো : 

১। রোজাদারের শরীরে রক্ত পুশ করা। কোনো কারণে যদি শরীরে রক্ত পুশ করা হয় তাহলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। 

২। ইনজেকশন পুশ করা। শরীরের ক্লান্তি দূর করার জন্য ইনজেকশন কিংবা স্যালাইন পুশ করলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। কারণ এমন ইনজেকশন নিলে পানাহারে প্রয়োজন হয় না।  তবে যেসব ইনজেকশন পানাহারের স্থলাভিষিক্ত নয় চিকিৎসার  জন্য নেয়া হচ্ছে তাহলে রোজা ভাঙ্গবে না। সাবধানতা স্বরূপ এসব ইনজেকশন রাতে নেয়া যেতে পারে। 

৫। ইচ্ছাকৃত ভাবে বমি করা

যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত ভাবে মুখে হাত দিয়ে অথবা পেট কচলিয়ে কিংবা ইচ্ছাকৃত ভাবে এমন কিছু শুকছে বা দেখছে যার কারণে সে বমি করছে তাহলে তার রোজা ভেঙ্গে যাবে। তবে যদি কারো পেট ফেঁপে থাকে তার জন্য বমি আটকে রাখা বাধ্যতামূলক নয়; কারণ এতে করে তার স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে।[শাইখ উছাইমীনের মাজালিসু শাহরি রামাদান, পৃষ্ঠা-৭১]

৬। শিঙ্গা লাগানো 

শিঙ্গা লাগানোর মাধ্যমে শরীর থেকে রক্ত বের করা হলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। দলিল হচ্ছে— নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “যে ব্যক্তি শিঙ্গা লাগায় ও যার শিঙ্গা লাগানো হয় উভয়ের রোযা ভেঙ্গে যাবে।”[সুনানে আবু দাউদ (২৩৬৭), আলবানী সহিহ আবু দাউদ গ্রন্থে (২০৪৭) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন] রক্ত দেয়াও শিঙ্গা লাগানোর পর্যায়ভুক্ত। কারণ রক্ত দেয়ার ফলে শরীরের উপর শিঙ্গা লাগানোর মত প্রভাব পড়ে। তাই রোযাদারের জন্য রক্ত দেয়া জায়েয নেই।

 তবে যদি অনন্যোপায় কোন রোগীকে রক্ত দেয়া লাগে তাহলে রক্ত দেয়া জায়েয হবে। রক্ত দানকারীর রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং সে দিনের রোজা  কাযা করবে।[শাইখ উছাইমীনের ‘মাজালিসু শারহি রামাদান’ পৃষ্ঠা-৭১]

আর যদি অনিচ্ছাকৃত ভাবে রক্ত ক্ষর হয় তাহলে রোজা ভাঙবে না। আর দাঁত তোলা, ক্ষতস্থান ড্রেসিং করা কিংবা রক্ত পরীক্ষা করা ইত্যাদি কারণে রোযা ভাঙ্গবে না; কারণ এগুলো শিঙ্গা লাগানোর পর্যায়ভুক্ত নয়। কারণ এগুলো দেহের উপর শিঙ্গা লাগানোর মত প্রভাব ফেলে না।

৭। হায়েজ -নেফাস 

কোন নারীর হায়েয কিংবা নিফাসের রক্ত নির্গত হওয়া শুরু হলে তার রোযা ভেঙ্গে যাবে; এমনকি সেটা সূর্যাস্তের সামান্য কিছু সময় পূর্বে হলেও। আর কোন নারী যদি অনুভব করে যে, তার হায়েয শুরু হতে যাচ্ছে; কিন্তু সূর্যাস্তের আগে পর্যন্ত রক্ত বের হয়নি তাহলে তার রোযা শুদ্ধ হবে এবং সেদিনের রোযা তাকে কাযা করতে হবে না।

আর হায়েয ও নিফাসগ্রস্ত নারীর রক্ত যদি রাত থাকতে বন্ধ হয়ে যায় এবং সাথে সাথে তিনি রোযার নিয়ত করে নেন; তবে গোসল করার আগেই ফজরহয়ে যায় সেক্ষেত্রে আলেমদের মাযহাব হচ্ছে— তার রোযা শুদ্ধ হবে।

রোজার মাকরূহ গুলো হলো 

 ১। কোনো জিনিস চিবানো 

২। কোনো দ্রব্য মুখে দিয়ে রাখা 

৩। গড়গড়া কুলি করা ,নাক দিয়ে পানি টেনে নেওয়া। যদি নাক দিয়ে পানি পাকস্থলীতে পৌঁছে যায় তাহলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। মাকরূহ হবে না। 

৪। ইচ্ছাকৃত ভাবে মুখে থুথু জমা রেখে তা গলাধঃকরণ করা 

৫। গীবত ,ঝগড়া ,গলা-গালি করা 

৬। সারা দিন নাপাক অবস্থায় থাকা। 

৭। অস্থিরতা ও কাতরতা প্রকাশ করা 

৮। মাজন ,পেস্ট ইত্যাদি দ্বারা দাঁত পরিষ্কার করা 

৯। (৩) তরকারি, তৈরিকৃত খাবার ইত্যাদির স্বাদ গ্রহণ করে ফেলে দেয়া। তবে কোন চাকরের মুনিব বা কোন নারীর স্বামী বদ মেজাজী হলে জিহ্বার অগ্রভাগ দিয়ে লবন চেখে তা ফেলে দেওয়ার অবকাশ আছে।

১০।  নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকবে না এরূপ মনে হওয়া সত্ত্বেও স্ত্রীকে চুম্বন করা ও আলিঙ্গন করা। আর রোজা অবস্থায় স্ত্রীর ঠোঁট মুখে নেয়া সর্বাবস্থায় মাকরূহ।

যে কারণে রোজা  না রাখলে গুনাহ হবে না , কাযা আদায় করতে হবে 

১। অসুস্থতার কারণে কিংবা অসুখ বৃদ্ধির ভয় হলে রোজা  কাযা করা যাবে 

২। কোনো নারী সন্তানকে দুধ পান করায় রোজা রাখলে সন্তান দুধ পায় না তাহলে রোজা নারেখে কাযা করা যাবে। 

৩ হায়েজ -নেফাসের সময় মেয়েদের রোজা না রেখে কাযা করে দিতে হবে। 

৪। মুসাফির অবস্থায় রোজা না রাখার অনুমতি আছে। 

৫। কোনো রোগী ক্ষুদা বা পিপাসায় এমন পর্যায়ে চলে গেছে ,কোনো চিকিৎসকের মোতে রোজা না ভাঙ্গলে মৃত্যুর আশঙ্কা আছে তাহলে রোজা ভঙ্গ করা ওয়াজিব। পরে কাযা করে দিতে হবে। 

৬।  স্ত্রী কিংবা সন্তান রোজা রাখার কারণে প্রাণ নাশের আশঙ্কা থাকলে রোজা না রেখে কাজ করে দিতে হবে। 

Sharing Is Caring:

Leave a Comment