ফরজ গোসল করার সঠিক নিয়ম জেনে নিন

মহান আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি সকল জীবের মধ্যে  শ্রেষ্ঠ জীব হলো মানুষ। মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত অর্থাৎ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জব বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষের জিবন পরিচালনা করার জন্য নানা রকম নিয়ম তৈরী করেছেন। যা মণ প্রত্যেকটি মানুষের জরুরি। 

মানুষ কিভাবে জীবন পরিচালনা করবে মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা) এর মাধ্যমে আমাদের বলে দিয়েছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম কাজ করার হুকুম দিয়েছেন। যেগুলো পালন করা কোনো সময় ফরজ ,কোনো সময় সুন্নত আবার কোনো সময় ওয়াজিব  হয়ে থাকে। 

ইসলামের যাবতীয় হুকুম-আহকাম পালন পবিত্রতার উপর নির্ভর করে। এ জন্য পবিত্রতাকে ঈমানের অঙ্গ বলা হয়েছে। এখানে পবিত্রতা বলতে জাহেরী ও বাতেনী উভয় প্রকার নাপাকী হতে পবিত্র হওয়াকে বুঝানো হয়েছে। 

পবিত্রতা সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন মজীদে বলেছেন ,‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তাওবাকারী ও পবিত্রতা অর্জনকারীকে ভালবাসেন ( সূরা : বাকারা )

অন্য আয়াতে বলেছেন ,‘তোমরা যদি অপবিত্র অবস্থায় থাক, তবে নিজেদের শরীর (গোসলের মাধ্যমে) ভালোভাবে পবিত্র করে নাও।’ (সুরা মায়েদা ,আয়াত নং  : ৬)

অপবিত্র থেকে পবিত্র হওয়ার অন্যতম উপায় হলো ওযু ,গোসল অথবা অপবিত্র জায়গা পরিষ্কার করা।  রাসূল সা. এরশাদ করেন, ‘যখন কোনো মুসলিম অথবা মুমিন বান্দা অজু করে আর সে তার মুখ ধোয় তখন অজু অথবা অজুর পানির শেষ ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে তার চেহারা থেকে সব গুনাহ বের হয়ে যায়, যা সে তার দু’চোখ দিয়ে করেছিল। 

যখন সে তার দু’হাত ধোয় তখন অজুর পানি অথবা অজুর পানির শেষ ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে তার উভয় হাত থেকে সব গুনাহ বের হয়ে যায়, যা সে তার হাত দিয়ে করেছিল। শেষ পর্যন্ত সে তার গুনাহ থেকে পাক হয়ে যায়।’ [তিরমিযী]

আর গোসলের মাধ্যমে পবিত্র হওয়ার বিভিন্ন ধরণ হাদিসে বলা হয়েছে। যেমন ফরজ ,সুন্নত ,ওয়াজিব। বিশেষ কারণে গোসলের পার্থক্য হয়ে থাকে। 

ফরজ গোসলের কারণ 

১। অপবিত্র থেকে পবিত্র হওয়ার গোসল। এটি নারী-পুরুষের যৌন মিলন, স্বপ্নদোষ বা যে কোনো উপায়ে বীর্যপাত হলে। এ গোসলকে জানাবতের গোসল বলে এবং গোসল না করা পর্যন্ত নাপাকী অবস্থায় থাকাকে জানাবতের অবস্থা বা জুনুবী হওয়া বলা হয়। জানাবত তথা ফরজ গোসলে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার। 

স্বামী-স্ত্রী দুজনই যৌনাঙ্গের পবিত্রতার ব্যাপারে খুবই যত্নবান হতে হবে। স্বামী তার অঙ্গকে খুব ভালোভাবে ধুয়ে নিবে যেনো চামড়ার মধ্যে বীর্য আটকে থাকতে না পারে।অনুরূপভাবে স্ত্রীও নিজের গোপন অঙ্গকে ভালোভাবে ধুয়ে নিবে। জানাবাত হতে পবিত্র হওয়ার পদ্ধতিকে বলে ফরজ গোসল।

২।  মাসিক বন্ধ হওয়ার পর নারীদের পবিত্র হওয়ার জন্য গোসল করা ফরজ।

৩।  সন্তান প্রসবের পর নেফাসের রক্ত বন্ধ হলে পবিত্র হওয়ার জন্য নারীদের গোসল করা ফরজ।

৪।  আর জীবতদের জন্য মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেওয়া ফরজ।

৫।  ইসলাম গ্রহণ করলে। (নব মুসলিম হলে)

সুন্নত গোসলের কারণ 

১।  জুমার নামাজ পড়ার আগে গোসল 

২। দুই ঈদের নামাজের আগে গোসল 

৩। আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করার জন্য গোসল 

৪। ইহরাম পরিধানের জন্য গোসল 

মুস্তাহাব গোসলের কারণ 

১।  শবে বরাত ও শবে কদরের রাতে গোসল 

২। মৃত ব্যক্তিকে গোসল করার পরে নিজে গোসল করা 

৩। সফর থ্রকর প্রত্যাবর্তনের আগে 

৪।  শিঙ্গা লাগানোর পরে 

৫। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার সময়, যদি সে পাক থাকে তবু গোসল করা মুস্তাহাব। কিন্তু সে যদি নাপাক থাকে, তবে তো গোসল করা ফরজ, মৃত ব্যক্তিকে গোসল দানকারীর জন্য 

ফরজ গোসলের নিয়ম 

সকল কাজের একটা নিয়ম আছে। গোসলের ও একটা নিয়ম আছে। যা মেনে চলা আমাদের সবার জরুরি। আমরা অনেকেই গোসলের সঠিক নিয়ম জানি না। আমরা সঠিক নিয়ম না জেনেই গোসল করে থাকি যার কারণে আমাদের গোসল সঠিক হয় না। 

আমরা অপবিত্র থেকে যাই ,পবিত্র হতে পারি না। এ অবস্থায় নামাজ। রোজা ,আমল কোনো কিছুই কবুল হয় না। সওয়াবের পরিবর্তে গুনাহ হয়ে থাকে। তাই আমাদের ফরজ গোসলের সঠিক নিয়ম মেনে গোসল করতে হবে। 

গোসলের পদ্ধতি 

ফরজ গোসলের জন্য গোসলের পূর্বে পেশাব করে নেওয়া উচিত।  গোসলের জন্য মনে মনে নিয়ত করতে হবে।তারপর  দুই হাত কব্জি পর্যন্ত ৩ বার ধৌত করতে হবে।এরপর ডানহাতে পানি নিয়ে বামহাত দিয়ে লজ্জাস্থান এবং তার আশপাশ ভালো করে ধৌত করতে হবে। শরীরের অন্য কোন জায়গায় বীর্য বা নাপাকি লেগে থাকলে সেটাও ধৌত করতে হবে।

এবার বাম হাতকে ভালো করে ধৌত করতে হবে।তারপর ‘বিসমিল্লাহ’ বলে ওজুর নিয়মের মত করে ওজু করতে হবে অর্থাৎ “বিসমিল্লাহ” বলে ডান হাতে পানি নিয়ে উভয় হাতের কব্জি পর্যন্ত তিনবার ধোয়া, তিনবার কুলি করা, তিনবার নাকে পানি দিয়ে নাক ঝাড়া, কপালের গোড়া হতে দুই কানের লতি ও থুঁতনির নীচ পর্যন্ত, প্রথমে ডান হাত ও পরে বাম হাত তিনবার ধোয়া আংগুলে আংটি থাকলে, মেয়েদের হাতে, কানে, নাকে গহনা থাকলে তা নেড়ে-চেড়ে ভিজিয়ে নেয়া, সম্পূর্ণ মাথা মাসেহ করা।

অতঃপর প্রথমে মাথায় তিনবার পানি ঢেলে চুলের গোড়ায় খিলাল করে ভালভাবে পানি পৌঁছাবে।পুরুষের দাড়ি ও মাথার চুল এবং মহিলাদের চুল ভালোভাবে ভিজঁতে হবে। গোসলের সময় মেয়েদের মাথার খোপা খোলার দরকার নেই। কেবল চুলের গোড়ায় তিনবার তিন চুল্লু পানি পৌঁছাতে হবে।

এবার সমস্ত শরীর ধোয়ার জন্য প্রথমে ৩ বার ডানে তারপরে ৩ বার বামে পানি ঢেলে ভালোভাবে ধৌত করতে হবে, যেন শরীরের কোন অংশই বা কোন লোমও শুকনো না থাকে।

গোসল এমনভাবে করতে হবে, যাতে বগল, নাভী ও কানের ছিদ্র পর্যন্ত বাহিরের পানি দ্বারা ভিঁজে যায়। অতপর আবার সমস্ত শরীরে পানি ঢালবে। সবার শেষে একটু অন্য জায়গায় সরে গিয়ে দুই পা ৩ বার ভালোভাবে ধৌত করতে হবে।

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, মায়মুনা (রা.) বলেন, আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর জন্য গোসলের পানি রাখলাম। তা দিয়ে তিনি জানাবাতের (অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হওয়ার) গোসল করেন। আল্লাহর নবী (সা.) পাত্র হাতে নিয়ে নিজের ডান হাতের ওপর কাত করে তা দুই বা তিনবার ধৌত করেন। অতঃপর তিনি তাঁর লজ্জাস্থানের ওপর পানি ঢেলে— বাম হাত দিয়ে ধৌত করেন। পরে তিনি মাটির ওপর হাত ঘষে (দুর্গন্ধমুক্ত হওয়ার জন্য) তা পানি দিয়ে ধৌত করেন।

অতঃপর তিনি কুলি করেন এবং নাক পরিষ্কার করেন। অতঃপর মুখমন্ডল ও দুই হাত ধৌত করেন। এরপর তিনি নিজের মাথা ও সর্বাঙ্গে পানি ঢালেন। পরে তিনি সেই স্থান থেকে অল্প দূরে সরে গিয়ে উভয় পা ধৌত করেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ২৪৫)

ফরজ গোসলের পরে আর নতুন করে ওযু করতে হবে না।  হযরত ‘আয়েশা রা. বলেন, নবী মুহাম্মদ সা. ফরজ গোসলের পর আর ওযূ করতেন না। (তিরমিযী : ১০৩, মিশকাত : ৪০৯)

ফরজ গোসল অবহেলার শাস্তি 

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, একদা আমি আমার এক প্রতিবেশীর জানাজায় যোগদান করি। তার লাশ কবরে নামানোর সময় বিড়ালের ন্যায় একটি অদ্ভুত জানোয়ার কবরের ভিতরে বাইরে লম্বঝম্প করে লাশ কবরে নামাতে বাধার সৃষ্টি করতে লাগলো। সেটিকে তাড়াবার জন্য সকলে মিলে চেষ্টা করলাম।

কিন্তু কোনো প্রকারই দূর করা গেল না। ব্যর্থ হয়ে অন্যত্র গিয়ে কবর খনন করা হল। সেখানে গিয়ে জন্তুটি ভয়ানক উৎপাত করতে লাগলো। সেটিকে মারতে গিয়েও সর্ব প্রকার চেষ্টা ব্যর্থ হলো।

অগত্যা বাধ্য হয়ে অন্যত্র গিয়ে তৃতীয় কবর খনন করা হল। সেখানে গিয়েও জন্তুটি আরও বেশি উপদ্রব শুরু করলো। অনন্যোপায় হয়ে আমরা তাড়াতাড়ি তৃতীয় কবরেই তাকে দাফন করতঃ সভয়ে দ্রুতপদে সেখানে হতে প্রস্থান করলাম।

দাফনান্তে কবর হতে বজ্রবৎ ভীষণ এক আওয়াজ বের হয়েছিল। আমি জানার জন্য তার স্ত্রীর কাছে জিজ্ঞেস করলাম, তার স্ত্রী উত্তর দিলো, সহবাসের পর তিনি ফরজ গোসলে অবহেলা করতেন। এতে তার ফজরের নামাজ কাজা হয়ে যেতো। এছাড়া তার অন্য কোনো পাপ আমি কখনো দেখি নাই।

Sharing Is Caring:

Leave a Comment