ফেরেশতা মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিনের এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। ফেরেশতা সব সময় আল্লাহর ইবাদাতে মগ্ন থাকে ও তার গুনগান গায়। ফেরেশতা সার্বক্ষণিক মহান আল্লাহর নির্দেশ পালনে ব্যস্ত থাকে।তারা সব সময় নিষ্পাপ ও পবিত্র থাকে। যার কারণে মহান আল্লাহ তায়ালা যাদের দোয়া সব সময় কবুল করে থাকে।
কিছু মানুষ এমন কাজকর্ম করে তা দেখে ফেরেশতারা খুশি হয়ে মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করতে থাকে। মানুষের জন্য ফেরেশতাদের দোয়া করার বিষয়টি কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত।
এমন কিছু আমল আছে যেগুলোর মাধ্যমে ফেরেশতাদের দোয়া পাওয়া যায়। সে আমলগুলোর কিছু উল্লেখ করা হলো :
১। ওযু করে ঘুমানো
ঘুম মানুষের ক্লান্তি দূর করে। কাজ করতে করতে শরীরে অবসাদ সৃষ্টি হয় তা দূর করতে ঘুমের প্রয়োজন। একজন সুস্থ সবল ব্যক্তির জন্য প্রতিদিন ৬ -৮ ঘন্টা ঘুমের প্রয়োজন।
ওযুর মাধ্যমে বাহ্যিক পবিত্রতার পাশাপাশি মানসিক প্রফুল্লতাও লাভ করা যায় যে ব্যক্তি রাতে ঘুমানোর পূর্বে ওযু করে ঘুমায় ওই ব্যক্তির জন্য ফেরেশতা মহান আল্লাহ তায়ালার নিকট দোয়া করতে থাকে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি অজু করে রাতযাপন করেন তাঁর শিয়রে একজন ফেরেশতা রাতযাপন করেন। তিনি যখন ঘুম থেকে জাগ্রত হন (কোনো কোনো বর্ণনা মতে, যতবার ঘুমের ভেতর নড়াচড়া করেন) তখন ওই ফেরেশতা বলতে থাকেন, হে আল্লাহ! অমুককে মাফ করে দিন। কেননা তিনি পবিত্র অবস্থায় রাতযাপন করেছেন।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ১০৫১)
হজরত বারা ইবনে আজিব রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বলেছেন,‘যখন তুমি তোমার শয্যা গ্রহণের ইচ্ছা করবে, তখন নামাজের ন্যায় অজু করে ডান কাত হয়ে শোবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
অপর হাদীসে এসেছে,ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,রাসূল ﷺ বলেছেন,‘তোমাদের এই শরীরকে পবিত্র রাখ।আল্লাহ তোমাদেরকে পবিত্র করবেন।
যে ব্যক্তি পবিত্রাবস্থায় (ওযূ অবস্থায়) রাত অতিবাহিত করবে,অবশ্যই একজন ফেরেশতা তার সঙ্গে রাত অতিবাহিত করবেন।রাতে যখনই সে পার্শ্ব পরিবর্তন করে তখনই সে ফেরেশতা বলেন, হে আল্লাহ! আপনার এই বান্দাকে ক্ষমা করুন। কেননা সে পবিত্রাবস্থায় (ওযূ অবস্থায়) ঘুমিয়েছে’।
২। মসজিদে প্রথম কাতারে নামাজ আদায় করা
বাড়িতে একা একা নামাজ পড়া অপেক্ষায় জামায়াতের সাথে নামাজ আদায় করা উত্তম। জামায়াতের সাথে নামাজ আদায় করলে ২৫ / ২৭ গুন্ সওয়াব বেশি পাওয়া যায়।
তাছাড়া প্রথম কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করলে তার জন্য ফেরেশতারা দোয়া করতে থাকেন। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথম কাতারের মুসল্লিদের জন্য তিনবার ও দ্বিতীয় কাতারের মুসল্লিদের জন্য একবার দোয়া করেছেন।
বারা বিন আজেব (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রথম কাতারে সালাত আদায়কারীর প্রতি রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতারা রহমতের দোয়া করেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৯৮৭)
৩। কাতারের ডান দিকে নামাজ পড়া
প্রত্যেক কাতারের বাম দিক থেকে ডান দিক উত্তম। আল্লাহ তাআলা নামাজের জামাতের প্রথম কাতার এবং কাতারের ডান দিকের ওপর রহমত বষর্ণ করেন।
রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ সেসব মানুষের প্রতি রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতারা রহমতের দোয়া করেন, যারা কাতারের ডান পাশে সালাত আদায় করে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৫৭৮)
৪। কাতারের মাঝখানে খালি জায়গা পূরণ করা
রাসুল (সা.) ইরশাদ করয়েছেন , ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতারা রহমতের দোয়া করেন, যারা কাতারের সঙ্গে মিলিত হয়ে সালাত আদায় করে। আর যে ব্যক্তি কাতারের ফাঁকা জায়গা পূরণ করে, আল্লাহ এর কারণে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৯৮৫)
৫। নামাজের জন্য অপেক্ষা করা
এক ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে অন্য ওয়াক্ত নামাজ পড়ার জন্য অপেক্ষা করে জায়নামাজে বসে থাকে তার জন্য ফেরেশতারা দোয়া করতে থাকে। হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যতক্ষণ বান্দা নামাজের স্থানে বসে নামাজের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে ততক্ষণ সে নামাজেই থাকে।
আর ফেরেশতাগণ বলতে থাকেন।‘হে আল্লাহ! তাকে করুণা করুন। এভাবে ফেরেশতাগণ দোয়া করতে থাকেন। বান্দা যতক্ষণ পর্যন্ত না (ওই ব্যক্তি) নামাজের স্থান ত্যাগ করে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
৬ । হজরত মুহাম্মদ (সা) এর ওপর দরুদ পড়া
যে ব্যক্তি রাসূল (সা) এর ওপর দরূদ পাঠ করে ফেরেশতারা খুশি হয়ে তার জন্য দোয়া করতে থাকে এবং তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। তছাড়া দরূদ পাঠ করলে অনেক ফজিলত পাওয়া যায়।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন ওই ব্যক্তি আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী হবে, যে আমার উপর সবচেয়ে বেশি দরূদ পড়েছে।’ (তিরমিজি)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন, ‘যে আমার উপর একবার দরূদ পড়বে আল্লাহ তার উপর ১০টি রহমত নাজিল করবেন, তার ১০টি গুনাহ ক্ষমা করা হবে এবং ১০টি (রহমতের) দরজা খুলে দেওয়া হবে।’ (মুসনাদে আহমদ, নাসাঈম মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন ওই ব্যক্তি আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী হবে, যে আমার উপর সবচেয়ে বেশি দরূদ পড়েছে।’ (তিরমিজি)
আবদুল্লাহ বিন আমের বিন রাবিয়া তাঁর পিতা (আমের) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, আমি রাসুল (সা.)-কে মিম্বারে বক্তব্য দিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি আমার প্রতি দরুদ পেশ করবে ফেরেশতারা তার জন্য দোয়া করবে।
তারা ততক্ষণ পর্যন্ত দোয়া করতে থাকবে যতক্ষণ সে দরুদ পেশ করতে থাকে। সুতরাং কম হোক বেশি হোক—যার ইচ্ছা সে দরুদ পড়তে পারে।’ (সহিহুল জামে, হাদিস : ৫৭৪৪)
৭। রোগীর সেবা করলে
অসুস্থ ব্যক্তিকে সেবা করা সুন্নত। রাসূল (সা) যে কাজ করেছেন এবং যে কথা বলেছেন তা সবই সুন্নত কাজের অন্তর্ভুক্ত। রাসূল (সা) অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যেতেন এবং সেবা করতেন।
যারা বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণে অসুস্থ ব্যক্তিদের দেখতে যায়, তার জন্য ফেরেশতারা দোয়া করতে থাকেন।
হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি সকালে কোনো মুসলমান রোগীকে দেখতে যায়, সত্তর হাজার ফেরেশতা সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য নেক দোয়া করতে থাকেন।
যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় কোনো মুসলমান রোগীকে দেখতে যায়, পরদিন সকাল পর্যন্ত নেক দোয়া করতে থাকেন। আর ওই ব্যক্তিকে জান্নাতের একটি বাগান দান করা হয়।’ (তিরমিজি)
অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘যখন তুমি কোনো রোগীর কাছে যাবে কিংবা মরণোন্মুখ ব্যক্তির কাছে যাবে, তখন তার সঙ্গে মঙ্গলজনক কথাবার্তা বলো। কেননা তুমি যা বল, ফেরেশতাগণ তার (ওই ভালো কথার) ওপর ‘আমিন’, ‘আমিন’ বলতে থাকেন।’ (মুসলিম ও মিশকাত)
৮। মুসলিম ভাইয়ের জন্য দোয়া করা
যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির জন্য তার অনুপস্থিতিতে দোয়া করে তাহলে আল্লাহ তায়ালা তার দোয়া কবুল করেন এবং তার জন্য ফেরেশতারাও দোয়া করতে থাকেন।
রাসুল (সা.) বলেছেন, কোনো মুসলিম তার অনুপস্থিত ভাইয়ের জন্য দোয়া করলে তা কবুল করা হয় এবং তার মাথার কাছে একজন ফেরেশতা নিযুক্ত থাকে। যখন সে তার ভাইয়ের জন্য কল্যাণের দোয়া করে তখন নিযুক্ত ফেরেশতা বলে, আমিন।
অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! কবুল করুন এবং তোমার জন্য অনুরূপ (তোমার ভাইয়ের জন্য যা চাইলে আল্লাহ তোমাকেও তা দান করুন)।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৮৮)
হজরত উম্মে দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, আমার স্বামী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি যদি তার কোনো ভাইয়ের জন্য তার পেছনে (তার অনুপস্থিতিতে) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, তবে ফেরেশতা সে দোয়া (কবুলে) ‘আমিন’ বলেন। (আর কান্নাকাটি করে দোয়া করলে) নিজের জন্যও এ দোয়া কবুল হয়।’ (মুসলিম)
৯। দান করলে
রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘প্রতি সকালে মানুষ যখন ঘুম থেকে ওঠে দুজন ফেরেশতা আসেন। তাঁদের একজন বলেন, ‘হে আল্লাহ! খরচকারীর ধন আরো বাড়িয়ে দিন।’ আর দ্বিতীয়জন বলেন, ‘হে আল্লাহ! কৃপণকে ধ্বংস করে দিন।’ (মুসলিম, হাদিস : ২২২৬)
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘শয়তান মানুষের মনে প্রেরণা জাগায় আবার ফেরেশতারাও মানুষের মনে প্রেরণা জাগায়।
শয়তানের প্রেরণা অশুভ ও অকল্যাণের ওয়াদা করা এবং সত্যকে অস্বীকার করার প্রেরণা। আর ফেরেশতার প্রেরণা হলো কল্যাণ ও মঙ্গলের ওয়াদা করা এবং সত্যকে মেনে নেয়ার প্রেরণা।
অতঃপর তিনি কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করেন।‘শয়তান তোমাদেরকে অভাব অনটনের ভীতি দেখায় এবং অশ্লীলতার আদেশ দেয়। পক্ষান্তরে আল্লাহ তোমাদের নিজের পক্ষ থেকে ক্ষমা ও বেশি অনুগ্রহের ওয়াদা করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সুবিজ্ঞ।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২৬৮)
১০। দ্বীনি জ্ঞান শেখানো
রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতারা রহমতের দোয়া করেন, যারা মানুষকে কল্যাণকর বিষয় (দ্বিনি জ্ঞান) শেখায়। এমনকি গর্তের পিপীলিকা ও সাগরের মাছ তাদের জন্য রহমত ও মাগফিরাতের দোয়া করে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৬০৯)
১১। রোজার জন্য সাহরী খাওয়া
রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘সাহরি খাওয়া বরকতের বিষয়। তোমরা তা পরিত্যাগ কোরো না। এমনকি এক ঢোক পানি পান করে হলেও (সাহরি খাও)। কারণ যারা সাহরি খায় আল্লাহ তাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতারা তাদের জন্য দোয়া করে।’ (মুসনাদ আহমদ, হাদিস : ১১৮৭)
১২। সকাল-সন্ধ্যা সুরা হাশরের শেষ তিন আয়াত পাঠ করা
হজরত মাকাল বিন ইয়াসার (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি সকালবেলা তিনবার পড়বে ‘আউজুবিল্লাহিস সামিয়িল আলিমি মিনাশ শাইতানির রাজিম।
তারপর সুরা হাশরের শেষ তিন আয়াত তেলাওয়াত করবে, তাহলে আল্লাহতায়ালা সে ব্যক্তির জন্য ৭০ হাজার ফেরেশতা নিযুক্ত করেন; যারা ওই ব্যক্তির জন্য মাগফিরাতের দোয়া করতে থাকেন সন্ধ্যা পর্যন্ত।
আর এ সময়ের মধ্যে যদি লোকটি মারা যায়, তাহলে সে শহীদের মৃত্যু লাভ করে। আর যে ব্যক্তি এটি সন্ধ্যার সময় পড়বে, তাহলে তার একই মর্যাদা রয়েছে। (মাগরিব থেকে সকাল পর্যন্ত সময়ের জন্য ৭০ হাজার ফেরেশতা গোনাহ মাফের জন্য দোয়া করেন, আর সে সময়ে মারা গেলে শহীদের সওয়াব পাবে)। (সুনানে তিরমিজি)