পুলসিরাত কি ?
পুল ফারসি শব্দ। এর অর্থ সেতু বা বন্ধন ।আর সিরাত আরবি শব্দ ।এর অর্থ রাস্তা বা পথ । ইসলামী পরিভাষায় এর অর্থ পারলৌকিক সেতু বা পুল।জাহান্নামের ওপর নির্মিত সেতুকে পুলসিরাত বোঝানো হয়েছে। পুলসিরাত হচ্ছে জান্নাতে যাওয়ার পথে চূড়ান্ত পরীক্ষা।
কেয়ামতের পর মহান আল্লাহ তায়ালা সব মানুষকে পুনরুজ্জীবিত করে হাশরের মাঠে সমাবেত করবে। তারপর ইহলৌকিক জীবনের হিসাব- নিকাশ করা হবে। এ বিচারের পর হাশরের মাঠ থেকে পুলসিরাত পারি দিতে হবে।
পুলসিরাত হাশরের মাঠ থেকে জান্নাত পর্যন্ত থাকবে। পুলসিরাত হবে অনেক ভয়ঙ্কর। পুলসিরাতের চুলের চেয়ে সুক্ষ এবং তরবারির থেকেও ধারালো।পুলসিরাতের রাস্তা হবে বড় পিচ্ছিল।
তার ওপর থাকবে আঁকশি বা আকরা। দুই পাশে থাকবে লোহার শলাকা থাকবে প্রশস্ত কাটালো যার কাটা গুলো হবে বাঁকানো। এ ধরনের গাছ নাজদ এলাকায় হয় যাকে ‘সাদান ‘তথা কাতাদার গাছ বলা হয়। এবং নিচে থাকবে জাহান্নাম। অরে পুলসিরাতের শেষ প্রান্তে থাকবে জান্নাত।
পুলসিরাতের রাস্তায় কোনো আলো থাকবে না। যার যার আমলের আলো দিয়ে সে পথ অতিক্রম করবে। দুনিয়ার আমলই হবে পুলসিরাতের রাস্তা পার হওয়ার আলো।
হজরত আবু সায়িদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসুলকে (সা.) জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! পুলসিরাত কেমন হবে? নবীজি বললেন, তা মসৃণ ও পিচ্ছিল হবে, তাতে থাকবে অসংখ্য লৌহ শলাকা ও আংটা। আর থাকবে অসংখ্য কাঁটাযুক্ত দাঁতালো মাথা।’ (বুখারি, হাদিস : ৭৪৩৯; মুসলিম, হাদিস : ১৮৩)
পুলসিরাত যেভাবে অতিক্রম করবে
শুধু মুমিন ব্যক্তিরাই সহজে পুলসিরাত পার হতে পারবে। কাফের ,মুশরিক ব্যক্তিরা জাহান্নামে পতিত হবে। দুনিয়াতে যারা মূর্তি পূজা করত এবং বিভিন্ন দেব -দেবীর পূজা করত তারা তাদের উপাস্য ও নেতাদের সাথে জাহান্নামে যাবে।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে একটি দীর্ঘ হাদিস বর্ণিত হয়েছে, তাতে রয়েছে, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা সব মানুষকে একত্র করে বলবেন, দুনিয়ায় তোমরা যে যে জিনিসের উপাসনা করেছিলে, সে তার সঙ্গে চলে যাও।
অতএব সূর্যের উপাসনাকারী সূর্যের সঙ্গে, চন্দ্রের উপাসনাকারী চন্দ্রের সঙ্গে এবং মূর্তিপূজারি মূর্তির সঙ্গে চলে যাবে। অবশিষ্ট থাকবে এই উম্মতের লোকেরা। তাদের মধ্যে মুনাফিকরাও থাকবে।
তখন জাহান্নামের ওপর পুলসিরাত স্থাপন করা হবে। সেদিন সর্বপ্রথম আমি সেই পুলসিরাত অতিক্রম করব। আর সেদিন সব রাসুলের দোয়া হবে ‘আল্লাহুম্মা সাল্লিম, আল্লাহুম্মা সাল্লিম’, অর্থাৎ, ‘হে আল্লাহ! রক্ষা কর, রক্ষা কর।’ (বুখারি : ৬২০৪; মুসলিম : ১৯৫)
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন ,‘তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে তথায় পৌঁছবে না। এটা আপনার রবের সুনিশ্চিত সিদ্ধান্ত। অতপর আমি পরহেজগারদের মুক্তি দেব আর জালেমদেরকে সেখানে নতজানু অবস্থায় ছেড়ে দেব।’ (সুরা মারইয়াম : আয়াত ৭১-৭২)
সব মানুষকেই পুসিরাতের সম্মুখীন হতে হবে।সব ব্যক্তরা পুলসিরাত পার হতে পারবে না। মুমিন ও নেককার ব্যক্তিদের রাস্তা হবে প্রশস্ত ও সুগম। মুমিন ব্যক্তিরাই কেবল পুলসিরাত সহজে পার হতে পারবে।
অন্যান্য মানুষ তাদের আমল অনুযায়ী পুলসিরাত পার হবে।তাদের জন্য পুলসিরাতের রাস্তা হবে সুক্ষ ও চিকন। পুলসিরাত পা রাখা মাত্রই তাদের পা কেটে জাহান্নামে পতিত হবে। তাদের আমল অনুযায়ী তারা জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে।
পুলসিরাত অত্যন্ত অন্ধকার থাকে। দুনিয়াতে মানুষ যে যা আমল করছে সে অনুযায়ী সে নূরের আলো পাবে।
হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সবাইকে সবার আমল অনুপাতে নূর দেওয়া হবে। কারো সামনে পাহাড় পরিমাণ নূর দেওয়া হবে। কারও হাতে মশাল পরিমাণ নূর দেওয়া হবে। কারও নূর হবে একটি বৃক্ষের পরিমাণ।
এভাবে সবচেয়ে কম নূর যাকে দেওয়া হবে তার নূর হবে পায়ের একটা আঙুলের মাথা পরিমাণ। একবার জ্বলবে একবার নিভবে। যখন আলো জ্বলবে তখন পথ চলবে, আর যখন নিভে যাবে তখন দাঁড়িয়ে থাকবে।’ (মুসতাদরাকে হাকেম : ৩৪২৪)
যে যার আমলের অনুযায়ী নূরের আলো পেয়েছে সে আলো দিয়ে পথ অতিক্রম করবে। যাদের আমলের পরিমান বেশি তারা খুব দ্রুত পুলসিরাত পার হতে পারবে।
আর যার আমল কম সে তার আমলের অনুযায়ী হেটে ,দৌড়িয়ে, হামাগুড়ি দিয়ে ,ঘোড়ার গতিতে পুলসিরাত পার হবে। তাদের আমল যতটুকু সে অনুযায়ী পুলসিরাতের রাস্তা ততটুকু পার হতে পারবে।
ততটুকু যাওয়ার পরে জাহান্নামে পতিত হবে। পুলসিরাতের যে আঁকশি ও কাটা থাকবে মহান আল্লাহ তায়ালার আদেশে তাকে টেনে ধরে জাহান্নামে ফেলে দেবে ।
উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জাহান্নামের ওপর একটি পুল আছে, যা চুলের চেয়েও বেশি চিকন আর তরবারির চেয়েও বেশি ধারালো।
এর ওপর লোহার শিকল ও কাঁটা থাকবে। মানুষ এর ওপর দিয়েই গমন করবে। কেউ চোখের পলকে, কেউ বিদ্যুৎ গতিতে, কেউ বায়ুবেগে আর কেউ উত্তম ঘোড়া ও উটের গতিতে পুলসিরাত পার হবে।
আর ফেরেশতারা বলতে থাকবে, হে প্রভু! সহিসালামতে অতিক্রম করাও, হে প্রভু! নিরাপদে পার করাও। কেউ নাজাত পাবে, কেউ আহত হবে, কেউ উপুড় হয়ে পড়ে যাবে আর কেউ অধঃমুখী হয়ে জাহান্নামে পড়ে যাবে।’ (মুসনাদে আহমদ : ২৪৮৪৭)
পরে গুনাহগার ঈমাদারদেরক গুনাহ অনুপাতে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করার পর জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে। আর মুনাফিকরা চিরকালের জন্য জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে থাকবে। (আন নিহায়া, ইবনুল আসির : ৪/২৪)
সব শেষে ব্যক্তি পুসিলাত পার হবে সে পেটে ভর দিয়ে পার হবে ।এ প্রসঙ্গে হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘অতঃপর তোমাদের সর্বশেষ ব্যক্তি পেটে ভর করে করে পুলসিরাত অতিক্রম করবে।
সে বলতে থাকবে, হে রব! আমাকে এত বিলম্ব করানো হলো কেন? তখন আল্লাহ বলবেন, আমি কেন তোমাকে বিলম্ব করাব? তোমাকে তো তোমার আমল বিলম্ব করিয়েছে।’ (মুসতাদরাকে হাকেম : ৮৫১৯)