একজন মুমিন ব্যক্তির জীবনে সব থেকে অন্যতম ইবাদাত হলো সালাত বা নামাজ।নামাজ এমন একটি ইবাদত যার মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য গ্রহণ করা সম্ভব হয়। কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তায়ালা সর্ব প্রথম নামাজের হিসাব নিবেন। হাদিস শরীফে বলা হয়েছে ,রাসূল (সা.) বলেছেন, কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম নামাজের হিসাব হবে। (তিরমিজি)
মহান আল্লাহ তায়ালা নামাজের গুরুত্ব দিয়েছেন অনেক বেশি। পবিত্র কুরআনে ৮২ বার নামাজের কথা বলা হয়েছে। অন্য কোনো বিষয় নিয়ে এত বার বলা হয়নি। নামাজকে বেহেশতের চাবি কাঠি বলা হয়।
আমরা অনেকেই প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে থাকি। কিন্তু নামাজে দাঁড়ালে অনেক সময় দুনিয়াবী চিন্তা মাথায় চলে আসে। যার কারণে নামাজে মধ্যে অনেক রকম ভুল করে থাকি এবং অনেক সময় রাকাত সংখ্যা ভুলে যাই। এক হাদিসে রাসুল (সা.) এটিকে ‘শয়তানের ছিনতাই’ বলেছেন।
নামাজে মনোযোগী হওয়ার উপায় অনেক। এ বিষয়ে শেখ মো. সালেহ আল মোলাজ্জেদ (রা.) একটি কিতাবও লিখেছেন। পরবর্তী সময়ে আরো অনেকেই লিখেছেন, অনেকগুলো বই আছে। নামাজে মনোযোগ তৈরির জন্য, যাতে মনঃসংযোগ নামাজের মধ্যে খুব নিবিড় করা যায় এ জন্য কী কী পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়, সে বিষয়গুলো রয়েছে।
১। তাহারাত হাসিল করা অর্থাৎ পবিত্রতা অর্জন করা
নামাজে দাঁড়ানোর আগে সর্ব প্রথম পবিত্রতা অর্জন করতে হবে। পবিত্রতার ক্ষেত্রে যদি কোনো ত্রুটি থাকে তাহলে নামাজে মনোযোগ আসবে না। পবিত্র না হলে সেখানে শয়তান থেকে যাবে। শয়তান নামাজে বাধা দিবে। সালাতের মনোযোগ বিনষ্ট করবে শয়তান এই তাহারাতের ত্রুটির সুযোগ নিয়েই।
নামাজের জন্য ওযু করা ফরজ। ওযুর শুরুতে বিসমিল্লাহ বলে শুরু করা। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অজুতে আল্লাহর নাম স্মরণ করা না হয় সে অজু পরিপূর্ণ নয়! তাই অজু শুরু করার আগে অবশ্যই ‘বিসমিল্লাহ’ পড়ে অজু শুরু করা।
‘নামাজে মনোযোগী ও গুনাহমুক্ত হতে শুরু থেকেই হক আদায় করে অজু করা। কেননা অজুতে হাত ধোয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাত দ্বারা সংঘটিত গুনাহ পানির সঙ্গে ধুয়ে চলে যায়। এমনিভাবে প্রতিটি অঙ্গ ধোয়ার সঙ্গে সে অঙ্গের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুনাহও ধুয়ে মুছে চলে যাওয়ায় অজুকারী ব্যক্তি পাক-সাফ হয়ে যায়। আর তাতে সে পূর্ণ মনোযোগের সঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারে।
২। নামাজে ‘হুজুরে দিল’ বা একাগ্র থাকা
একাগ্রতা নামাজের প্রাণ। নামাজে দাঁড়ালে শয়তান বারবার মনোযোগ ছিন্ন করা চেষ্টা করে। তাই এমন ভাবে নামাজে দাঁড়াতে হবে যেন আল্লাহ তায়ালা আমাকে দেখছেন এটা মনে করতে হবে। নামাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই ভাবনা ধরে রাখলে নামাজে মনোযোগ আসবে।
হজরত মুহাম্মদ (সা) বলেন, ‘এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করো, যেন তাকে তুমি দেখতে পাচ্ছো। আর যদি দেখতে না পাও, তবে তিনি যেন তোমাকে দেখতে পাচ্ছেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৫০; মুসলিম, হাদিস : ৮)
রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে সুন্দরভাবে অজু করে, অতঃপর মন ও শরীর একত্র করে একাগ্রতার সঙ্গে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে (অন্য বর্ণনায় এসেছে যে নামাজে ওয়াসওয়াসা স্থান পায় না), তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায় (অন্য বর্ণনায় রয়েছে, তার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়)।’ (নাসাঈ, হাদিস : ১৫১; বুখারি, হাদিস : ১৯৩৪)
হজরত মুহাম্মদ (সা) আরো বলেছেন ,‘যে ব্যক্তি নামাজের সময় হলে সুন্দরভাবে অজু করে এবং একাগ্রতার সঙ্গে সুন্দরভাবে রুকু-সিজদা করে নামাজ আদায় করে, তার এ নামাজ আগের সব গুনাহর কাফফারা হয়ে যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত না সে কোনো কবিরা গুনাহে লিপ্ত হয়। আর এ সুযোগ তার সারা জীবনের জন্য।’ (মুসলিম)
৩। নামাজে বিশুদ্ধ তেলাওয়াত করা
নামাজে যা কিছু পাঠ করা হয় তা বিশুদ্ধ উচ্চারনে ধীরে ধীরে তেলাওয়াত করতে হবে। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন ,‘স্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে কোরআন তিলাওয়াত করো।’ (সুরা : মুযযাম্মিল : আয়াত ৪)
হাদিস শরীফে বলা হয়েছে ,রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিটি সুরা তারতিলের সঙ্গে তেলাওয়াত করতেন। (মুসলিম, তিরমিজি)
৪। অর্থ বুঝে তেলাওয়াত করা
নামাজে যা কিছু তেলাওয়াত করা হয় তা অর্থ বুঝে তেলাওয়াত করতে হবে। অর্থ না বুঝলে নামাজে মনোযোগী হওয়া খুব কষ্টকর। তাই নামাজে যা কিছু তেলাওয়াত করা হয় তা বিশুদ্ধ উচ্চারণের সাথে সাথে অর্থ বুঝে তেলাওয়াত করতে হবে। তাহলে নামাজে মনযোগ আসবে।
৫। আন্তরিকতার সাথে নামাজ পড়া
আন্তরিকতার সাথে নামাজ আদায় করতে হবে। না ওই নামাজে মনোযোগ আসবে না। মহান আল্লাহ তায়ালা নিজে আন্তরিকতার সাথে নামাজ আদায় করতে বলেছেন। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনে একটি আয়াত নাজিল করেছেন। আয়াত টি হলো তোমরা আল্লাহর সামনে বিনীতভাবে দাঁড়াও।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২৩৮)
আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিকৃষ্টতম চোর হলো সেই ব্যক্তি, যে নামাজে চুরি করে।’ জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! নামাজে কিভাবে চুরি করে? তিনি বলেন, ‘যে আন্তরিকতার সাথে রুকু-সিজদা পূর্ণভাবে আদায় করে না।’ (মুসনাদ আহমাদ, মিশকাত, হাদিস : ৮৮৫)
৬। নামাজে আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করা
নামাজে দাঁড়িয়ে মহান আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করতে হবে। মনে করতে হবে এটাই জীবনের শেষ নামাজ হতে পারে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তির উপদেশ কামনায় বলেছিলেন, ‘যখন তুমি নামাজে দাঁড়াবে তখন এমনভাবে নামাজ আদায় করো, যেন এটিই তোমার জীবনের শেষ নামাজ।’ (ইবনে মাজাহ, মিশকাত)
৭। সেজদার স্থানে তাকানো
নামাজে মনোযোগী হতে হলে যে স্থানে সেজদাহ দিবে ওই স্থানের দিকে তাকিয়ে নামাজ আদায় করতে হবে। সেজদার স্থানের দিকে তাকিয়ে নামাজ আদায় করলে নামাজে মনোযোগ আসে। ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (নিজেই) দাঁড়ানো অবস্থায় সেজদার জায়গায় দৃষ্টি রাখতেন।’ (তাফসিরে তবারি)
৮। নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে কল্যাণ আশা করা
মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৪৫)
এই বিশ্বাস রাখুন, আল্লাহ আমার প্রতিটি প্রার্থনায় সাড়া দিচ্ছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ নামাজে দাঁড়ালে সে মূলত তার প্রভুর সঙ্গে কথোপকথন করে। তাই সে যেন দেখে, কিভাবে সে কথোপকথন করছে।’ (মুসতাদরাক হাকেম, সহিহুল জামে হাদিস : ১৫৩৮)